আমেরিকার লস এন্জেলেস প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটির অন্যতম উৎসব এখন বৈশাখ- এস এম বাবু

203

লসএঞ্জেলস প্রতিনিধি :  আজ বৈশাখের প্রথম দিন,৮ই ফাল্গুন,লাল-সাদা পাঞ্জাবি আর জিন্স পরে হয়তো বা রঙের খেলা দেখা হবে বন্ধুদের সাথে। হয়তো কেউ কেউ প্রিয় মানুষটিকে মনের কথাটাও জানাবে রঙচঙে দিনটায়।পহেলা বৈশাখ দিনটি বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটা বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে উৎসবের সাথে পালিত হয়।বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতি বছর বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে।পশ্চিমবঙ্গের বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। দুই দেশেরই বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়।

ঐতিহ্যগতভাবেই এই উৎসব শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তা ভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে উদযাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল, ‘শুভ নববর্ষ’। বাংলা দিনপঞ্জির সাথে হিজরী এবং খ্রিস্টীয় সনের পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসেবে এবং খ্রিস্টীয় সন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় আকাশে নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার পর আর খ্রিস্টীয় সনে নতুন দিন শুরু হয় মধ্যরাত থেকে। কিন্তু পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু না হয়ে সূর্যোদয় থেকে শুরু হয়।সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস অনেককাল আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু ও ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ‘আর্তব উৎসব’ তথা ‘ঋতুধর্মী উৎসব’ হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ।

আরবি হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি। মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে বাংলার কৃষকদের সুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এ দেশের ঋতু পরিবর্তনের সাথে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা হয়। কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দেয়। কৃষকের সমস্যা দূর করতে এবং জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। বাংলা নববর্ষ বাঙালির হলেও সেটির আনন্দ ও আমেজটা কৃষকের ঘরেই বেশি দেখা যেত। যদিও বর্তমান সময়ের নববর্ষ উদযাপনে পান্তাভাত ও ইলিশ ভাজাসহ মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটলেও এতে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। ধনী ও বিলাসী মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র ও অসহায় মানুষের অন্তরে প্রকৃত সুখ আসে না। আধুনিক যুগের শহরের মানুষের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের ডামাডোলে হারিয়ে যাচ্ছে নিবিড় পল্লির প্রীতিপূর্ণ ছোট ছোট উৎসবগুলো। উঠতি ধনীদের প্রভাব ও বড়োলোকি মনোভাবের কাছে বাঙালি কৃষকের সেই উৎসবেরও রূপ বদলে গেছে।

একটা সময় গ্রামগঞ্জে বৈশাখী মেলা বসত। সেসব মেলা এখন কমে গিয়েছে। কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য, আসবাবপত্র ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ত সেসব মেলায়। মেলার সময় নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর, এমনকি মেলায় ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বলী খেলা ইত্যাদি বিনোদন ও ক্রীড়া অনুষ্ঠান বসতো। তখন মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই বৈশাখী মেলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠত। শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি, মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল গলার হার ইত্যাদিও। এ ছাড়া জুড়ি-বুন্দি, জিলাপি, রসগোল্লাসহ নানা ধরনের মিষ্টি ও মুখরোচক খাবারের সমারোহ ছিল বেশ চমৎকার। একটা সময় কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিনে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। এরপর দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ ভূমির মালিকেরা তাদের প্রজা সাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। পরবর্তীতে তা ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানিরা সারা বছরের বাকির খাতা সমাপ্ত করার জন্য পয়লা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসেন দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। একটা সময় হালখাতার এ রেওয়াজ খুব দেখা গেলেও সময়ের পরিক্রমায় সেটি কমে এসেছে।

পয়লা বৈশাখ বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে একটি উৎসবের দিন হিসেবে পরিগণিত। এ দিনটি উদ্‌যাপিত হোক আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে। বিশ্বায়নের বিভ্রান্তি থেকে নতুন প্রজন্মকে হতে হবে শেকড়সন্ধানী। তরুণ-যুব ও শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয় মূল্যবোধ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার চেতনা জাগ্রত হয়।বর্তমানে সামাজিক ও লোক উৎসবের এই দিনটি একটি সাংস্কৃতিক দিবসে রূপ নিয়েছে।তবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সবচেয়ে বড় শক্তি নারী। কারণ রান্না, নবান্ন বা কৃষিকাজ সবখানেই নারীর সরব উপস্থিতি। নারী ছাড়া নববর্ষের আলাদা কোনো তাৎপর্য নেই। সারা বিশ্বেই দেশে দেশে যেখানে বাঙালি নারীরা আছেন সেখানেই কোনো না কোনোভাবে বাংলা নববর্ষের আয়োজন করা হয়। গত দুবছরে করোনার কারণে যা প্রায় স্থগিতই ছিল। তবে এবারে স্বল্প পরিসর আর স্বল্প আয়োজনে হলেও বিশ্বের বাঙালি পরিবারগুলো বাংলা নববর্ষের মাধ্যমে সুখানন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টায় থাকবে। পহেলা বৈশাখ মানেই রবীন্দ্রনাথের সেই গান, ‘এসো হে বৈশাখ’ বেজে ওঠে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির হৃদয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি পরিবারের বাহারি পদের ভর্তার সঙ্গে পান্তা ভাতের আয়োজন। প্রবাসে বছরে দুই ঈদ ছাড়া পহেলা বৈশাখ এখন আলাদা গুরুত্ব নিয়ে আসে। পুরুষের সঙ্গে নারীদের সাজসোজ্জা আর রান্নার কারণে নারীরা এ উৎসবের প্রধান উপজীব্য। তা ছাড়া এবারে বৈশাখ রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষার বিষয় আছে। তবে হিন্দু বাঙালিরা প্রবাসে সম্মিলিতভাবে বাংলা নববর্ষের আয়োজনের মাত্রাকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। বাংলাদেশি ভূখণ্ডের বাইরেও বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি প্রাণের উৎসব বৈশাখ। বাংলাদেশ, ভারত ও আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালির মধ্যে প্রাণ-সঞ্চারিত হয়। নিত্যনতুন কিছু যুক্ত হয় পহেলা বৈশাখ।